মাঝেমধ্যেই আমি ভাবিতে থাকি এমন কি কোনো পাঠশালা এখনো স্থাপিত হয় নাই দুনিয়ায়, যে্ইখানে ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতা প্রাপ্ত হইবার পর ক্ষমতাসীন শিখিবেন বিরোধীয় মঞ্চের নিচে পুঁতিয়া রাখিতে নাই ৭৬কেজি ওজনের বোমা। আমাদের নেতৃবৃন্দ যেইখানে সহোদরকে প্রতিপক্ষ না ভাবার প্রশিক্ষণ পাইবেন। মানুষ হত্যা হইতে যেন তাঁহারা সরিয়া আসেন। তাঁহারা যেন বোঝেন মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, দুস্কৃতি, গেরিলা-তামিল, হিন্দু-মুসলমান এভাবে যেখানে যাঁহাকে হত্যা করিয়া শক্তির স্বপ্নে যাঁঁরই মৃত্যু উল্লেখ করিয়া উল্লাস করা হোক কেন তাঁহারা যেন স্মরণ করেন, মানুষই মরিয়াছে এবং মানুষের মৃত্যু বড়ই করুণ এবং বড়ই দুঃখজনক।
এমন কি কোনো পাঠশালা নাই, যেইখানে রাষ্ট্র পরিচালিকা শিখিতেন ভোট লুট করিয়া ক্ষমতায় যাইতে নাই। এমন একখানাও বিদ্যালয় নাই দুনিয়ায়! যেইখানে কতক ডাক্তার শিখিবেন মৃত লাশ আইসিইউ’এ আটকাইয়া রাখিয়া টাকা কামাইবার প্রয়াস করা পৃথিবীর সবচাইতে বড় পাপ। আমাদের সেইসকল কৃষকগণ জানিবেন ফসলে বিষ মিশাইয়া মানুষ মারিয়া ক’পয়সাই বা লাভ হয়। আমাদের পিতৃসম শিক্ষকগণ প্রশ্নফাঁশ না করিবার শিক্ষাখানি পাইবেন।
মানুষের নিকটে মানুষের প্রত্যাশা পুরণ না হইলেও তিনি কিছু চাহিয়াছেন বলিয়া যেন রক্তপাত না হয় তাঁহার ভেতর ও বাহিরে। মানুষই যেন কাঁধ পাতিয়া দেন, মানুষই যেন মাথা রাখিয়া কাঁদিতে পারেন। সব অলংকারের শ্রেষ্ঠ অলংকার সরলতা, ক্ষমার চেয়ে বড় কোনো প্রতিশোধ নাই, ভালোবাসার চেয়ে শক্তিশালী কোনো নিউট্রন বোমা নাই, মানুষ কোথায় শিখিবে এই পাঠ।
এমন একটা পাঠশালা থাকিলে হিংস্ররা শিখিতেন ধর্ষন করিয়া, ছিন্নবিচ্ছিন্ন যোনি চিরিয়া ফালা করিয়া ভিতরে রক্ত মাংস কাদার মধ্য দিয়া হাত চালাইয়া ভেতর হ্নইতে নাড়িভুঁড়ি বাহির করিয়া আনিয়া আপাদমস্তক ঢুকিয়া পড়িয়া কখনো নারীর হৃদয় খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আর বাংলার শ্যামল বনের মতো সমস্ত রূপসীগণ শিখিতেন স্থির হইতে। জীবন অতিক্ষুদ্রাকার, যৌবনও থাকেনা চিরকাল, মানুষ মরিয়া যায় ক্ষণিক বসন্ত পর। সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, ‘গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন / কী লাভ যুদ্ধ করে?’ মানুষের হৃদয় ভেঙে, মানুষকে কষ্ট দিয়ে, ‘শত্রুতায় কী লাভ বলুন?’
মন চায় একখানা পাঠশালা বানাই এমন। কিন্তু আমি কেমন করিয়া এমন পাঠশালা বানাইব। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মহোদয়ের কবিতা স্মরণ হইল,- ‘অথচ আমি বৃক্ষহীন প্রান্তরের কথা বলতে চাই না / যুদ্ধ এবং আগ্নেয়াস্ত্রের কথা বলতে চাই না / বিশীর্ণ নদী কিম্বা রুক্ষ মৃত্তিকার কথা বলতে চাই না / ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন কৃষকের কথা বলতে চাই না। / কিন্তু আমি কেমন করে / মরা গাঙে বান আনবো / কৃষকের ঘরে শস্যের দানা তুলে দেবো / যুবকের বুকে ভালবাসার ধন তুলে দেবো / অথবা বর্ণ্যাঢ্য অরণ্য সৃষ্টি করবো? / এ সব কিছুর জন্য সাহস প্রয়োজন / আমার তেমন সাহস নেই। / যে সাহসী সে যুদ্ধে গেছে / যে সন্ত্রস্ত সে বর্ণের অধিকার থেকে বঞ্চিত / এবং আমার বিচিত্র শব্দাবলী বিবর্ণ / বৈশাখের শিলাপাতে আহত শস্যের মত বিচূর্ণ।’
গৃহবন্দী দিনগুলোর ভাবনা, ২৯ এপ্রিল ২০২০, বগুড়া সদর
নাভিদ ইবনে সাজিদ নির্জন
প্রধান সম্পাদক, বগুড়া ট্রিবিউন ডটকম