দিব্যশক্তি জগত-জননী শরতে অকালবোধনে
আসো তুমি অসুর বধে দেবীপক্ষে।
শুভশক্তি কৃপায় রক্ষণে অসুরকূলের ধ্বংস সাধনে,
মঙ্গলকারিনী তুমি ভগবতীই রক্ষে।।
করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবার হাত থেকে পৃথিবীর সন্তানদের রক্ষা করতে মাতা জগজ্জননীকে মর্ত্যে আবাহন জানাই। স্নেহময়ী মা হল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। কারণ মা আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, সব বিপদ থেকে আগ৪টএটলে রাখে, ভুল করলে বকে ও শাসন করে, আবার দুঃখ পেলে কাছে টেনেও নেয়। সান্ত্বনা ও শান্তি প্রদান করে। জাগতিক মায়ের পূর্ণরূপ সেই আদি শক্তি মাতা দুর্গা প্রতিবছর আসেন শারদোৎসবে সমূহ বিপদনাশিতে এবং সন্তানদের অনন্য অনন্ত সুখে
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল সনাতন ধর্মের দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজাে করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি।
নারীসত্ত্বা বা দেবীসত্ত্বাকে কেন্দ্র করে যে একাধিক ধর্ম গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো দেবীভাগবত পুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ,কালিকা পুরাণ,চণ্ডী পুরাণ, মহানির্বাণতন্ত্রে, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, হরিবংশ গ্রন্থ ইত্যাদি যেগুলো শাক্তদের প্রধান অনুস্মরণীয় ধর্মগ্রন্থসমূহ। এই গ্রন্থগুলোতে পরম সত্ত্বাকে নারীরূপে মহাবিদ্যা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। দেবীভাগবত-এর সপ্তম স্কন্দের শেষ নয়টি অধ্যায় ‘দেবী গীতা’ নামে পরিচিত।
মহাবিদ্যা কথাটি মূলত সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত মহা ( অর্থাৎ মহৎ ) ও বিদ্যা ( অর্থাৎ প্রকাশ, রূপ, জ্ঞান বা বুদ্ধি ) শব্দদুটি থেকে মহাবিদ্যা কথাটির উৎপত্তি। এর সঙ্গে কখনও কখনও সংখ্যাবাচক দশ কথাটি যুক্ত হয়ে থাকে।
‘মহাবিদ্যা’ অর্থাৎ বিশেষ রূপ বা প্রকাশ। মহাবিদ্যা বা দশমহাবিদ্যা সনাতন ধর্মে দেবী অর্থাৎ দিব্য জননী নিরাকার আদ্যাশক্তির সাকার দশটি বিশেষ রূপের সমষ্টিগত নাম। এই দশটি রূপ হল দেবী আদ্যাশক্তিরই দশটি স্বরূপ । দেবীত্বের এই ক্রমবিন্যাসের একদিকে যেমন রয়েছেন ভয়ংকর দেবীমূর্তি, তেমনই অপর দিকে রয়েছে রয়েছেন অপরূপ সুন্দরী দেবীপ্রতিমা।
নারায়ণের দশ অবতার যেমন সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়ে বিষ্ণুর আত্মপ্রকাশ তেমনই শক্তির দশটি রূপের প্রত্যেকটিই নারায়ণের ওই অবতারগুলির নারীরূপ বা প্রকৃতিরূপ। সৃষ্টির দশটি প্রধান বিষয়ও দেবীর এই দশ রূপের মাধ্যমে ফুটে ওঠে।
শ্রী শ্রী দুর্গা মাতার নবদুর্গা রূপ ও দাক্ষায়ণী সতীর দশমহাবিদ্যা রূপ ধারণের মধ্যে রয়েছে সুগভীর মেলবন্ধন। একই যোগমায়া আদ্যাশক্তি মায়ের বিভিন্ন লীলাকাহিনি। অত্র প্রবন্ধে মায়ের দশমহাবিদ্যা নিয়ে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার প্রয়াস করা হয়েছে।
কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।।
বগলা সিদ্ধ বিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।
এতা: দশমহাবিদ্যা: সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্ত্তীতা:।।
মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুসারে দশমহাবিদ্যা হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা-কামিনী। দেবীর এই দশ রূপ পরম জ্ঞানের প্রতীক এবং এনাদের সাধন করলে মোক্ষলাভ অর্জিত হয় এবং পরম জ্ঞান মেলে। তাই এনাদের বলা হয় দশমহাবিদ্যা। মহাবিদ্যাগন প্রকৃতিগত ভাবে তান্ত্রিক।
বৃহদ্ধর্মপুরাণে শক্তির এই দশ মহাবিদ্যা রূপ ধারণের পিছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনী। শিব ও তাঁর স্ত্রী তথা পার্বতীর পূর্বাবতার দাক্ষায়ণী সতীর মধ্যে একটি দাম্পত্য কলহ দশমহাবিদ্যার উৎস। প্রজাপতি দক্ষ যখন যজ্ঞের জন্য দেবলোক আর মৃত্যুলোকের অধিপতিদের নিমন্ত্রণ করেন,তখন মহাদেবপত্নী সতীও জেদ করতে লাগেন তাঁর পিতা দক্ষের এই যজ্ঞ দেখতে যাওয়ার। কিন্তু শিব তাঁকে নিষেধ করেন। তখন সতী অত্যধিক ক্রোধিত হন,এবং তাঁর তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত হয়ে অগ্নিবর্ষণ করতে থাকে। তিনি ক্রোধে কৃষ্ণাঙ্গী ভীষণা মহাকালীতে পরিণত হন। তাঁর এই মূর্তি এতোটাই ভয়ঙ্কর যে,স্বয়ং মহাদেব তা দেখে ভীত হয়ে পড়েন এবং তিনি পলায়ন করতে উদ্যত হন। তখন মহাকালী দশরূপে বিভক্তা হয়ে মহাদেবকে দশ দিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং অবশেষে মহাদেব তাঁর পত্নীকে পিতাগৃহে যাবার অনুমতি প্রদান করেন। দেবীর এই প্রকটিত হওয়া দশ রূপই হল দশমহাবিদ্যা।
পুরাণগুলোতে এই দশমহাবিদ্যার সম্পর্কে যে চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোর মূর্তিতত্ত্বের বর্ণনায় আসা যাক।
(১) কালী প্রথম মহাবিদ্যা :
মাতা কালীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋকবেদের দেবীসূক্তে। শাক্তরা ঈশ্বরকে যে প্রকৃতি ও পুরুষ রূপে ভজনা করেন,সেই প্রকৃতিই কালী যিনি সৃষ্টি করেন, বিনাশও করেন। ‘কালী’ অর্থাৎ যিনি কালকে হরণ করেছেন। দেবী কালিকা চতুর্ভুজা, বাম হাতের উপরে খড়্গ, নীচের হাতে মুণ্ড। ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা। দিগম্বরী দেবীর গলায় মুণ্ডমালা। শবরূপী শিবের উপর বিপরীত রতাতুরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। ইনি শাক্তদের পরম উপাস্য দেবী। ইনি কৃষ্ণাঙ্গী ও নগ্নিকা। ইনি শ্মশানচারিণী ও এনার বাহন শৃগাল। এনার সাথে মিল রয়েছে নবদুর্গার কালরাত্রীর। ইনি মুণ্ডমালিনী,ইনি রুষ্ট হলে প্রলয়নৃত্য করেন তাঁর স্বামী মহাকালের মতোই।
ডান পা আগে এবং বাম পা পিছনে থাকলে তাঁকে দক্ষিণা কালী বলে। ইনি সর্বসংহারকারিনী, জন্ম ও শক্তির দেবী।
শুম্ভ ও নিশুম্ভ বরে অজেয় হওয়ায় তাদের অত্যাচারে দেবগণের প্রার্থনায় দেবী দুর্গার ভ্রকুটি থেকে বেরিয়ে আসেন কালী। মহাভারত-এ কালীকে দুর্গার একটি রূপ হিসাবে উল্লেখ করা রয়েছে।
(২) তারা দ্বিতীয় মহাবিদ্যা :
শবরূপী শিবের হৃদয়ের উপর দাঁড়িয়ে দেবী। ডান পা সামনে, বাম পা কিছুটা পিছনে। চতুর্ভুজা দেবীর হাতে খড়্গ, নীল পদ্ম, কর্তৃকা ও খর্পর। করালবদনা, নিজের আবেশে হাস্যমুখী, বিশ্বব্যাপ্ত জলের মধ্যে শ্বেতপদ্মের উপর অবস্থিতা। তান্ত্রিক মতে,ইনি সেই পরম জ্ঞান প্রদান করেন যা তার ভক্তকে নির্বাণ বা মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। ইনি ব্রহ্মাণ্ডের পরম শক্তির উৎস। ইনিই আদিশক্তি। দেবী খর্বাকৃতি, লম্বোদর, নীলবর্ণ। তিনি বাঘ ছাল পরিহিতা। মাথায় জটা, সেখানে সাপের অধিষ্ঠান। দেবীর তিনটি রূপ- তারা, একজটা এবং নীল সরস্বতী। তারা পথপ্রদর্শক ও রক্ষাকারিনী দেবী। সমুদ্রমন্থনের পর স্বয়ং মহাকাল তার আরাধনা করেন এবং তাতে সন্তুষ্ট হয়ে মা তারা তাঁকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন।
(৩)ষোড়শী তৃতীয় মহাবিদ্যাঃ
ইনি ত্রিপুরাসুন্দরী নামেও পরিচিতা। ত্রিলোকের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ইনিই। ইনি মোক্ষদায়িনী নামেও পরিচিতা এবং মণিদ্বীপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ইনিই শক্তির আদিরূপ শ্রীবিদ্যা। তাঁর অপর নাম ললিতা,কামেশ্বরী এবং রাজ রাজেশ্বরী। এখানে ত্রিপুরা বলার অর্থ হল তাঁর চক্র ত্রিকোণাকার যেটা তন্ত্রমতে যোনীর প্রতীক। অর্থাৎ তিনি পরম অধিষ্ঠাত্রী। কামের দেবী তিনিই। আবার তিনি ত্রিপুরা কারণ,তিনি ত্রিগুণাতীত ,সত্ত্ব ,রজঃ আর তমঃ এর ঊর্ধ্বে। মানস,বুদ্ধি আর চিত্ত- তিনটির মধ্যেই তাঁর অবাধ বিচরণ। ইনি পুর্ণতা ও পুর্ণাঙ্গতার দেবী। কৃষ্ণবর্ণ, শিবের উপর উপবিষ্টা, ষোড়শবর্ষীয়া বালিকা। চতুর্ভূজা দেবীর দুই হাতে তীরধনুক। সূর্যের মত গায়ের রং। ষোড়শীতন্ত্রে ত্রিপুরাসুন্দরীকে ‘শিবের নয়নজ্যোতি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কৃষ্ণবর্ণা ও শিবোপরি উপবিষ্টা
তিনি সর্বসৌভাগ্যদায়িনী।
(৪) ভুবনেশ্বরী চতুর্থ মহাবিদ্যা :
দশ মহাবিদ্যার মধ্যে চতুর্থা ইনি মা দুর্গারই এক প্রতিরূপ।ইনি ভুবন অর্থাৎ সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরী। হিন্দু শাক্তদের দেবী ইনি। ইনি এতোই তেজস্বিনী যে এনাকে নবগ্রহ এবং ত্রিমূর্তিও ( ব্রহ্মা,বিষ্ণু আর মহেশ্বর) কোনো কাজ থেকে বিরত করতে পারেন না। ইনি ত্রিভুবনের (স্বর্গ,মর্ত্য আর পাতালের) রাণী আর চিন্তামণিগৃহে তাঁর নিবাস। তিনি যোগিনীদের দ্বারা পরিবৃতা হয়ে থাকেন সবসময়। তাঁর কন্ঠে রত্নখচিত পুষ্পহার ,তিনি চতুর্ভুজা ,রক্তবর্ণা ও রক্তবর্ণের বসন ও অলঙ্কার পরিহিতা। বিশ্বজননী ও পার্থিব জগতের শক্তির প্রতীক। তিনি তাঁর স্বামী ত্র্যম্বক ভৈরবের সঙ্গে পঞ্চপ্রেতাসনে বিরাজমানা। মহালক্ষ্মীস্বরূপা আদিশক্তি ভগবতী ভুবনেশ্বরী হচ্ছেন মহাদেবের সমস্ত লীলাবিভূতির সহচরী। বিশ্বের সমস্ত খারাপকে ধ্বংস করেন। রক্তবর্ণা দেবী সদাহাস্যময়ী। চতুর্ভুজা দেবীর একহাতে অঙ্কুশ, অন্য হাতে পাশ। বাকি দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা। দুর্গম অসুরের হাত থেকে তিনি দেবতাদের রক্ষা করেন তাই তাঁর আরেক নাম দুর্গা। আবার হাতে ধরা শাক ও ফলমূলে প্রাণীকুল রক্ষা করেন বলে দেবীর আরেক নাম শাকম্ভরী।
(৫)ভৈরবী পঞ্চম মহাবিদ্যা :
ইনি কুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠাত্রী এবং ভৈরবের সঙ্গিনী। ইনি ত্রিপুরা ভৈরবী নামেও পরিচিতা। ত্রিপুরা বলতে এখানে ইচ্ছাশক্তি ,জ্ঞানশক্তি এবং ক্রিয়াশক্তির কথা বলা হয়েছে। ভয়ঙ্করী এই বিদ্যার নিবাসস্থল তিব্বতের কৈলাস। ইনি চতুর্ভুজা এবং পদ্মের ওপর আসীন। তন্ত্রে কোনো যোগিনী যখন সিদ্ধিলাভ করেন,তখন তিনিও ভৈরবী রূপে পরিচিতা হন। ভয়ঙ্করী দেবী কামনা ও প্রলভনের স্বরুপ যা মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। সহস্র সূর্যের মতো উজ্জ্বল তাম্রবর্ণা দেবীর মাথায় জটা এবং কপালে শোভিত চন্দ্রকলা। রক্তবস্ত্র পরিহিতা, গলায় মুণ্ডমালা। বাম হাতে পুস্তক ও অভয় মুদ্রা। ডান হাতে বর মুদ্রা ও জপমালা। নৃসিংহের অভিন্ন শক্তি ত্রিপুরা ভৈরবী।
(৬)ছিন্নমস্তা ষষ্ঠ মহাবিদ্যা :
দ্বিভুজা দেবী দিগম্বরী। বাম হাতে নিজের কাটা মুণ্ড। ডান হাতে খর্পর। গলায় মুণ্ডমালা। ইনি প্রচণ্ড রক্ততৃষ্ণায় কাটা গলা থেকে নির্গত তিনটি রক্ত ধারার একটি দেবী নিজেই পান করছেন, অপর দুটি ধারা পান করছেন তাঁর দুই সহচরী। ইনি প্রচণ্ডা চণ্ডিকা নামেও পরিচিতা।
চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতার শক্তির প্রতীক।
দশমহাবিদ্যার মধ্যে তিনিই সবথেকে আতঙ্কের উদ্রেক করেন। ইনি নগ্নিকা,বন্য আর রক্ততৃষ্ণায় ভয়ঙ্করী।তাঁর দুই সঙ্গিনী ডাকিনী আর বর্ণিনী (জয়া ও বিজয়া) । তিনি ভয়ঙ্করী,আবার তিনিই আনন্দময়ী। তিনি যেমন শ্মশানবাসিনী,তেমনই তিনি অপরূপা অন্নপূর্ণা। তাঁর মধ্যেই বিরাজ করছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বৈপরীত্য। সেজন্যই তাঁর পায়ের তলায় কাম ও রতি বিপরীত রতিতে শয়ান। দেবীর এই রূপের পশ্চাতে রয়েছে একটি কাহিনি।
দেবী ভবানী তাঁর দুই সহচরী জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে একদিন মন্দাকিনীতে স্থান করতে গেছেন। স্নান সেরে উঠে দেবী ক্ষুধায় কাতর হলেন। তাঁর দুই সহচরীও ক্ষুধায় কাতর হয়ে তাঁর কাছে খাবার প্রার্থনা করলেন। দেবী অপেক্ষা করতে বলায় তাঁরা শিশুর মতো বায়না করতে লাগলেন। তখন দেবী নিজের খড়্গ দিয়ে নিজের মুণ্ড কেটে ফেললেন। মুণ্ড রইল তাঁর বাম হাতে ধরা। দুটি রক্তধারা পান করতে লাগলেন দুই সহচরী। তৃতীয় ধারাটি তিনি নিজেই পান করলেন।
(৭)ধূমাবতী সপ্তম মহাবিদ্যা :
অগ্নির দ্বারা জগৎ ধ্বংসের পর ভষ্মরাশির মধ্য থেকে যে ধূম নির্গত হয়, তাই দেবী ধূমাবতীর স্বরূপ।
ধূমাবতী বিধবা রূপধারিনী দেবী। তিনি কাকধ্বজ রথে চড়ে রয়েছেন। তাঁর গায়ের রং বিবর্ণ, পরণে মলিনবসন। এক হাতে কুলো, অন্য হাতে বর মুদ্রা। তিনি দুর্ভিক্ষ, অভাব, সংকটের দেবী। ইনি অলক্ষ্মী রূপেও পরিচিতা। শ্মশানে বিচরণকারিণী এই ভয়ঙ্কর দেবীর বাহন কাক। দশমহাবিদ্যার মধ্যে ইনিই চরম অশুভের প্রতীক। মহাপ্রলয়ের সময় এই দেবীর আবির্ভাব ঘটে এবং বলা হয় যে, দেবী দুর্গা শুম্ভ আর নিশুম্ভকে পরাস্ত করার সময় দেবী ধূমাবতীর সাহায্য নিয়েছিলেন।
পুরাণে রয়েছে যে শিবপত্নী পার্বতী একদিন মহাদেবের কাছে ক্ষুধার্ত হয়ে আহার প্রার্থনা করেন। তৎক্ষণাৎ মহাদেব তা দিতে অসমর্থ হলে তিনি ক্ষুধায় কাতর হয়ে মহাদেবকেই ভক্ষণ করেন। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে মহাদেবকে মুক্তি দেন। ফলস্বরূপ আবির্ভূতা হন ধূমাবতী। ধূমাবতীর তাৎপর্য এই যে,যখন পুরুষের বিনাশ ঘটে,তখন শক্তি তার অদৃশ্যরূপে বিরাজমান থাকে। প্রকৃতির মধ্যেই লীন হয়ে থাকে। ধূমাবতী তাঁর ভক্তদের সিদ্ধি এবং মোক্ষও প্রদান করেন।
৮) বগলা অষ্টম মহাবিদ্যা :
ইনি কল্যাণী বা পীতাম্বরী মা নামেও পরিচিত। ইনি তাঁর ভক্তের শত্রুদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত করতে সক্ষম। ইনি পীতবর্ণা এবং সিদ্ধি আর ঋদ্ধি প্রদান করেন। কামাখ্যা মন্দিরে ইনি পূজিতা হন। ইনি তাঁর দণ্ড দিয়ে মোহ আর বিভ্রান্তি দূর করে তাঁর ভক্তদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করেন।এনার বাহন শবদেহ। শত্রুনিষ্ক্রিয়কারিনী দেবী। মানব চরিত্রের ঈর্ষা, ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার অন্ধকার দিক নিয়ত্রণ করেন তিনি।
রত্ন সিংহাসনে আসীন দেবী বগলামুখী পীতবসনা। দ্বিভুজা দেবীর এক হাতে মুদ্গর অপর হাতে ধরা শত্রুর জিহ্বা। তবে কোথাও কোথাও চতুর্ভুজা দেখা যায়। বগলামুখী দেবীর আবির্ভাবের পিছনেও এক কাহিনী রয়েছে। একবার সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে প্রবল ঝড় উঠলো। তখন সৌরাষ্ট্র দেশে হরিদ্রা সরোবরের তীরে শ্রীবিষ্ণু ভগবতীর তপস্যা করলেন। মঙ্গলবার চতুর্দশীর মধ্যরাত্রে বগলামুখী রূপে দেবী আবির্ভূত হয়ে বিষ্ণুর সঙ্গে মিলিত হলেন। তাঁর আবির্ভাবে প্রলয় শান্ত হয়ে সৃষ্টি রক্ষা পেল এবং দেবী বৈষ্ণবী হলেন।
(৯) মাতঙ্গী নবম মহাবিদ্যা :
কলাবিদ্যা,জ্ঞান এবং শিক্ষার এই দেবী মাতা সরস্বতীরই তান্ত্রিক রূপ। এনার বাহন তোতাপাখি,এবং ইনিই বীণা বাদনরতা। ইনিই বাগদেবী,ইনিই সঙ্গীতের দেবী। ইনি রক্তবসনা এবং এনার গলায় গুঞ্জার মালা। ইনি দ্বিভুজা এবং একহাতে নরমুণ্ড এবং অপরহস্তে তরবারি। ষোড়শী এই দেবী পীবরোন্নতবক্ষা এবং রক্তবসনা,এনার গায়ের বর্ণ হরিৎ। কর্তৃত্ব শক্তির দেবী। জাতিহীন দেবী।
মাতঙ্গী দেবী সর্বসিদ্ধিদায়িনী। মতান্তরে তিনি শ্যাম বর্ণ, অর্ধচন্দ্র ধারিণী, চতুর্ভুজা দেবীর হাতে থাকে খড়গ, পাশ ও অঙ্কুশ। তাঁর গায়ের রং নীল। তিনি রক্তবস্ত্র পরে রত্ন সিংহাসনে বসে বীণা বাজাচ্ছেন। মাতঙ্গী পূর্ণতা তথা সরস্বতীর মূর্তি। মুণ্ডমালা অনুসারে,বিষ্ণুর বুদ্ধাবতার এই মাতঙ্গী দেবীর শরীর থেকেই নির্গত হন।
(১০) কমলা দশম মহাবিদ্যা:
দশমহাবিদ্যার এই দশম মহাবিদ্যা মহর্ষি ভৃগুর কন্যা।
তিনি লক্ষ্মী রূপে বিষ্ণুকে পতিরূপে বরণ করেছেন। তিনিই মা লক্ষ্মীর তান্ত্রিক প্রতিরূপ। দ্বিভুজা থেকে অষ্টভুজা পর্যন্ত কমলা রূপ পাওয়া যায়। দৈবাসুরের সমুদ্রমন্থনের ফলস্বরূপ তাঁর আবির্ভাব। তিনি পদ্মাসনা স্বর্ণবর্ণা। সাধারণত দুই হাতে দুটি পদ্ম, বাকি দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা। সোনার কলসে অমৃতজলে দেবীকে অভিষেকরত চারটি শ্বেতহস্তী। হাতি আসলে বৈভবের সূচক। তাই দেবী সমৃদ্ধি, সম্পদ, উর্বরতা ও সৌভাগ্যদায়িনীর প্রতীক। তিনি তাঁর ভক্তদের সাফল্য এবং সম্পদ প্রদান করেন। বরাভয় প্রদায়িনী শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী মাতা কমলা কামিনী।
দেবী হিন্দু ধর্মের একটি প্রকৃতি সত্তা যা স্বর্গীয়, ঐশ্বরিক বা শ্রেষ্ঠত্বকে বোঝায়। দেবী হলেন মাতৃকাশক্তি। তিনি সর্বাধিকা, সর্বশক্তিসমন্নিতা।এই শারদীয় দুর্গা মাতার মহা পূজাতে ভগবতী মায়ের শ্রীচরণকমলে একান্ত প্রার্থনা পৃথিবীর আনন্দ যজ্ঞের সকলেই যেন নিরবচ্ছিন্ন সুখ-শান্তি-আনন্দ লাভ করতে পারে। জয় হোক মানবতার।
শব্দ-গ্রন্থনায় :
চিত্তরঞ্জন সরকার
ইংরেজি শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কবি
chittaranjonsarkar@gmail.com