মির্জা গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯) মোঘল-সম্রাজ্যের শেষ ও ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের একজন উর্দু এবং ফার্সি ভাষার বিখ্যাত কবি। তাঁহাকে মোঘল সম্রাজ্যের সর্বশেষ কবি ও দক্ষিণ এশিয়ায় উর্দু ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি মনে করা হয়। মির্জা গালিব তাঁহার অনেক কবিতা আল্লাহকে উদ্দেশ্য করিয়া লিখিয়াছেন।
মির্জা গালিবের পান্ডিত্য সম্পর্কে ধারণা করা যায় তাহার লেখা পড়িবার পর, তিনি বলিলেন, “প্রভু, সে আমার কথা বোঝে নাই; হয় তাকে বোঝার ক্ষমতা দাও অথবা আমাকে দাও নতুন ভাষা, যে ভাষায় কথা বলিলে সে বুঝিবে।”
গালিব বলিতেন, মধু বড় আঠালো বস্তু; মাছি ইহার ওপর বসিলে আটকাইয়া যায়। মির্জা গালিব প্রায়ই বলিতেন ‘বুদ্ধিমান মাছি চিনির ওপরে বসে; মধুর ওপরে নয়’।
গালিব বলিতেন, “বিচ্ছেদ ঘনাইলে আর কাউকে পাইব না সেতাহা নয়; অপরে তোমাকে পাইবে- প্রতিদিন এই হয় ভয়।”
তিনি ইহাও বলিয়াছেন, “হাতের তালুর রেখায় ভাগ্য খুঁজিও না গালিব। ভাগ্য তাঁদেরও আছে যাঁদের হাত নাই।”
তিনি প্রচন্ড জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। শোনা যায়, একদা মির্জা গালিব মসজিদে বসিয়া মদ্যপান করিতেছিলেন। তখন মুসল্লিগণ তাঁকে বাধা দিয়া বলিলেন, মসজিদ আল্লাহর ঘর, মদ্যপানের জায়গা নয়।
গালিব মুসল্লিদের দিকে তাঁকাইলেন; তারপর আরেক চুমুক পান করিয়া আওড়াইলেন উপস্থিত শের,—
“শরাব পিনে দে মসজিদ মে ব্যায়ঠ কার,
ইয়া ও জাগা বাতা যাঁহা খুদা নেহি।”
(মসজিদে বসিয়াই আমাকে শারাব পান করিতে দাও,
অথবা আর একটা জায়গা আমাকে দেখাও যেইখানে আল্লাহ নাই।)
মুসল্লীরা লা জবাব। তাঁহারা আর কী জবাব দেবেন। খোদা নাই এমন জায়গার কথা বলা শক্ত বৈকি। তবে বহু বছর পর শের দিয়ে এর জবাব দিলেন আল্লামা ইকবাল। তখন মীর্জা আর বেঁচে নাই।
“ইয়া গালিব, মসজিদ খুদা কা ঘর হ্যায় পিনে কি জাগা নেহি,
কাফির কে দিলমে যা ওঁয়াহা খুদা নেহি।”
কাফির মানে অবিশ্বাসী। যার অন্তরে আল্লাহর জায়গা নাই। তাই গালিবকে সেখানে যেয়ে মদ্যপান করিতে বলিলেন আল্লামা ইকবাল৷
পরে আহমদ ফারাজ নামের আরেকজন কবি এর প্রতিউত্তরে লিখিলেন—
“কাফির কে দিল সে আয়া হু দেখ কার,
খুদা মওজুদ হ্যায় ওঁয়াহা উসসে পাতা নেহি।”
(কাফিরের মনে উঁকি দিয়া দেখিয়া আসিয়াসিলাম,
সেখানেও খুদা আছেন, কিন্তু কাফির জানেই না।)
তার জবাবে কবি ওয়াসি লিখলেন—
‘খুদা তো মওজুদ দুনিয়া মে হার জাগা,
তু জান্নাত মে যা ওঁয়াহা পিনে সে মানা নেহি।’
(আল্লাহ তো দুনিয়ার সবখানেই উপস্থিত আছেন,
তুমি জান্নাতে যাও, ওখানে মদ খেতে বাধা নাই।)
কবি ওয়াসি এখানে ‘শরাবান তহুরা’র কথা বলিলেন। যাহা জান্নাতবাসীগণ যত ইচ্ছা খাইতে পারিবেন। কিন্তু মাতাল হইবেন না। জান্নাতের মধ্যে হারাম-হালালের মাসয়ালা আসিবে না। সব বিধিনিষেধ শুধু দুনিয়ার জন্যই প্রযোজ্য।
এরপরে সাকি লিখলেন—
“পীতা হুঁ সাকি গাম-এ-দুনিয়া ভুলানে কে লিয়ে,
জান্নাত মে কৌন সা গাম হ্যায়, ইস লিয়ে ওঁয়াহা মাজা নেহি।”
সাকি বলিলেন, জান্নাতে তো দুনিয়াবি দুঃখ-কষ্ট থাকিবে না। সেখানে কষ্ট ভুলিবার জন্য মদ্যপান করার কোনো প্রয়োজনও পরিবে না আর মজাও পাওয়া যাইবে না।
নাভিদ ইবনে সাজিদ নির্জন
প্রধান সম্পাদক, বগুড়া ট্রিবিউন