পণ্ডিত লোক ওমর খৈয়াম। তাঁহার রুবাইয়াৎ ভীষণ অর্থবোধক গভীর গ্রন্থ। অদ্য হইতে প্রায় ১০০০ বছর পুর্বে ১০৪৮ খৃষ্টাব্দে ইরাণ দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়াম। তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম এর জন্য অধিক বিখ্যাত।
রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম পাঠ করিবার পর আমি ওমর খৈয়াম এঁর পান্ডিত্য সম্পর্কে ভাবিয়া বিস্মিত হইয়াছি।
রুবাইয়াৎ এঁর ৫৯ নম্বর কবিতা হইতে তিনি বলিতে শুরু করিলেন,— মাহে রমজান শেষে আকাশে ঈদের চাঁদ উঠিয়াছে, ওমর খৈয়াম তাঁহার এলাকার কুমোরের বিপণীগৃহে গেলেন, যেইখানে মাটির পণ্য প্রস্তুত ও বিক্রয় হইয়া থাকে। নানা পণ্য নানা বেশে সজ্জিত রহিয়াছে উক্ত বিপণীগৃহে।
রুবাইয়াৎ এ তিনি এইরকম লিখিলেন,—
সে কাহিনী শোনো, এক সন্ধ্যায় মাহে রমজান শেষে
আকাশে তখন ঈদের নতুন চাঁদটি উঠেছে হেসে
একাকী এসেছি কুম্ভকারের ক্ষুদ্র দোকানটিতে
নানা গড়নের পাত্র সেখানে সজ্জিত নানা বেশে।
মাহে রমজান শেষে আকাশে ঈদের চাঁদ উঠিয়াছে। ওমর খাইয়াম কুমোরের বিপণীগৃহে গেলেন। সেইখানে মাটির তৈরি নানা পণ্য নানা বেশে সজ্জিত রহিয়াছে। নানা গড়নের সজ্জিত পাত্র যে মানুষেরই মতন, ইহা তিনি ইশারায় প্রকাশ করিলেন। তারপর লিখিলেন,—
বিষ্ময়ে দেখি সরব-কন্ঠ কুম্ভ কয়েক সার
বাকী সবগুলি অনর-পিন্ড নীরব নির্বিকার;
সহসা তাদের কোনো একজন প্রশ্ন করল রোষে:
দয়া করে বলো কারা বা কুম্ভ কে বা সে কুম্ভকার।
কয়েকজন লোক বসিয়া আছেন কুমোরের বিপণীগৃহে। তাঁহারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করিতেছেন। তাঁহাদের একজন ক্ষিপ্ত স্বরে আন্যজনকে প্রশ্ন করিলেন,~ আমাদের সৃষ্টিকর্তাই বা কে? কী তার পরিচয়?
অপর কুম্ভ বলল : তা’হলে তাল তাল কাদা ছেনে
সৃষ্ট আমরা সে কি শুধু এই ছেলেখেলা হবে জেনে?
সুনিপুণ হাতে যিনি আমাদের গড়েছেন পরিপাটি
সে’কি আমাদের ভাঙতেই শুধুু আবার ধুলিতে আনে!
অন্যজন বলিলেন,~ তাল তাল কাদা মাটি ছানিবার পর সৃষ্টিকর্তা আমাদের সৃষ্টি করিলেন। তিনি কি শুধু আমাদের লইয়া এই ছেলে খেলা করিবার জন্য সৃষ্টি করিয়াছিলেন। সুনিপুণ হাতে যিনি আমাদের পরিপাটি করিয়া গড়িলেন, তিনি কি শুধুই আমাদের ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্যেই আবার ধুলিতে আনিবেন!
অপর কুম্ভ সে-কথায় হেসে বললো গভীর স্বরে:
দুষ্ট শিশুও আপন খেলনা ভাঙে না ‘ত ক্রোধভরে।
যে-জন গড়েছে এ-কুম্ভগুলি শত প্রীতি মমতায়
ভাঙবে সে পুন: আপন সৃষ্টি নির্মম অন্তরে!
একথা শুনিবার পর অপরজন হাসিতে হাসিতে গভীর স্বরে বলিলেন,~ সৃষ্টিকর্তা আমাদের মৃত্যু যেমন অবধারিত করিয়া রাখিয়াছেন, দুষ্ট শিশুও তো নিজের খেলনা এমন ক্রোধভরিয়া ভাঙেন না। এখানে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে দুষ্ট শিশুর চেয়েও হীণ মনে করিলেন।
এ-কথায় সরব কন্ঠ নীরবতা নিল মাখি
একটি কুম্ভ, অতি কদর্য, বললো : একটু বাকি
পরিহাস বলে মনে হতে পারে, তবু জিজ্ঞাসা করি
নির্মাণকালে কুম্ভকারের হাত কেঁপেছিল নাকি?
এই কথায় সবাই নীরব হইয়া রইলেন। আচমকা নিরবতা ভাঙিয়া একজন বলিলেন, একটুখানি বাকি রহিয়াছে। পরিহাস বলিয়া মনে হইতে পারে তবুও বলিতেছি,~ সৃষ্টিকর্তা যখন আমাদেরকে সৃষ্টি করিতেছিলেন তখন নাকি তাঁহার হাত কাঁপিতেছিল, ইহা ভাবিয়া যে একদিন তাঁহার প্রিয় এই সৃষ্টিকে কষ্ট দিয়া ধ্বংস করিতে হইবে।
মানুষের মৃত্যু অবধারিত, তাহারে চিরতরে চলিয়া যাইতেই হইবে। মানব শরীর বড়ই ক্ষণস্থায়ী। রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম এ বারবার এই কথাটাই বলা হইয়াছে। মৃত্যু নিশ্চিত, তাই দুনিয়ার সুধা ভোগ করবার আহ্বান জানানো হইল বারংবার। রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম এর একাংশে লেখা হইল,—
মাটির ধুলিতে জন্মের মতো লুপ্ত হবার আগে,
তা’হলে কুড়াই যা কিছু লভ্য সকলের পুরোভাগে।
ওমর খৈয়াম জানিতেন, তাঁহারে মরিয়া যাইতেই হইবে। তাই তিনি বলিলেন, মাটির ধুলিতে চিরজন্মের মতো হারাইয়া যাইবার আগে, জগতের এই ভান্ডার হইতে কুড়াইয়া লই যাহা কিছু লভ্য শুভ্র সুন্দর।
ওমর খৈয়াম বলিলেন,—
এবেলা সখা পিয়ে নাও সুধা, ঘুমাবার কাল অনেক পাবে,
কবর গুহায় পঁচিবে যখন, বান্ধব সেথা কেহ না রবে।
বোলো না কাহারে; শুনহ গোপনে একটি বচন সত্য সার—
যে ফুল নিশিথে পরিছে ঝরিয়া, সে নাহি কখনো ফুটিবে আর।
আমাদের মরিয়া যাইতেই হইবে, তাই তিনি এইবেলা সুধা পান করিবার আহ্বান করিয়াছেন। তিনি সুধা বলিতে দুনিয়ার যাবতীয় সুখকর বস্তু বুঝাইয়াছেন। তিনি উক্ত বচন গোপন রাখিবার কথা জানাইয়া গোপনে বলিলেন,~ যে ফুল গতনিশিথে ঝরিয়া পড়িয়া গেছেন তিনি আর কখনোই ফুটিবেন না, ইহা যেমন সত্য, মানুষের মৃত্যু হইলে তিনিও আর কখনোই ফিরিবেন না ইহাও তেমনই সত্য।
মুসাফির এসো উদ্দাম নব জীবনের নব রূপে
ভোগের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে নাও চুপে চুপে
গতবছরের তিক্ত স্মৃতির ক্রন্দন-রেখা যত।
শেষ হোক জ্বলে নব ফাগুনের সুভা সুরভীর ধুপে।
জীবনের ভোগের পেয়ালা কানায় কানায় ভরিয়া লইতে আহ্বান করিয়াছেন ওমর খাইয়াম। জীবনে তিক্ত স্মৃতির ক্রন্দন-রেখা যত, তাহাদের সুভা সুরভীর ধুপে পোড়াইবার কথা জানাইয়াছেন তিনি।
ওমর খৈয়াম বলিলেন,—
মাটির পেয়ালা দু’ঠোঁটে ছুঁইয়ে ধীরে ধীরে শুধালাম
এই জীবনের কী’বা রহস্য কতটুকু তার দাম?
মাটির পেয়ালা শোনালো আমাকে : ভোগ করো প্রাণ ভরে
মরণে হারালে ফিরবে না আর কোনো পরিচিত নাম।
তিনি মাটির পেয়ালা দু’ঠোঁটে ছুঁইয়ে জানিতে চাহিয়াছিলেন, এই জীবনের কী বা রহস্য কতটুকু তার দাম? মাটির পেয়ালা শুনাইয়াছিল,~ ‘মরণে হারাইয়া গেলে কেহ ফিরিবে না কোনোদিন। দুনিয়ায় যতক্ষণ বিচরণ করিতেছ, ইহার সুধা ভোগ করো প্রাণ ভরে।’ ইহাই ছিল মাটির পাত্রের উপদেশ।
ওমর খৈয়াম মরিয়া গেছেন, তিনি জানিতেন তাহাকে চিরতরে চলিয়া যাইতেই হইবে। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখিয়া রাখিয়া গেলেন,
আসবে, যেখানে জীবনের লোভে আমিও এসেছিলাম
তোমার শান্ত সুরভীতে আমি ক্লান্তি ঢেকেছিলাম,
সেই পরিচিত ভূমি পার হয়ে তুমি দিও গো উপুড় করে
একটি শূণ্য মদিরাপাত্র জড়ায়ে আমার নাম।
মধুমুখী প্রিয়া আবারো এই নিভৃত কুঞ্জবনে আসিবেন। যেখানে জীবনের লোভে আসিয়াছিলেন ওমর খাইয়াম। দুনিয়ার সুধার শান্ত সুরভীতে তিনি সকল ক্লান্তি ঢাকিয়াছিলেন। মরিয়া যাইবার পর কবরের ওপর নিজের নাম লেখা একখানি শূণ্য মদিরা-পাত্র রাখিবার শেষ ইচ্ছা তিনি জানাইলেন। তিনি জানিতেন সমাপ্তি সুনিশ্চিত।
সকলের কল্যান হোক। সুমিষ্ট সুধায় ভরে থাকুক জীবন আকণ্ঠ।
নাভিদ ইবনে সাজিদ নির্জন
প্রধান সম্পাদক, বগুড়া ট্রিবিউন