ইতি অপু -পৃথ্বীরাজ চৌধুরী

ইতি অপু -পৃথ্বীরাজ চৌধুরী

পুলু, কেমন আছিস, ভালো?
বড় তাড়াতাড়ি নিভে যাচ্ছে এই কলমের আলো।
মাঘ কুয়াশার চেয়েও ঝাপসা হচ্ছে অক্ষর,
কোথা দিয়ে কেটে গেল রে এতগুলো বছর?
যেন রেলের চাকায় বেঁধেছিল কেউ দিনঘড়িটার কাটা,
অনেক কষ্টে জোগার করেছি তোর ঠিকানাটা!
এই দেখ! পরিচয়টাই দেয়া হয়নি কথায় কথায়!
চিনতে পারছিস? রোল ফরটি-সিক্স, অপূর্ব কুমার রায়।
তোর সাথে শেষ দেখা, নাগপুর কোলিয়ারি।
তারপর জানিস? খুলনা গিয়েছিলাম অপর্ণাদের বাড়ি।
খুলনা তো এখন বাংলাদেশ
ওখানে কে থাকে,
আমি ছাড়া তোকে এখনো কেউ পুলু বলে ডাকে?
কাজল এখন বিয়ে করেছে, চাকরি করছে কলকাতায়
সেসব যাক, এবার আসি যেজন্য চিঠি সেই কথায়।
জানিনা, কোত্থেকে শুরু করব, ঠিক কোন দুঃখ ভোগ?
তোর সাথে প্রায় ত্রিশ বছর পরে তো যোগাযোগ!
তুই বলবি আমার দোষ, রাখিসনি কেন যোগাযোগ?
যোগ আর যোগ রাখব কোথায়, আয়ুষ্কালে শুধুই বিয়োগ!
ছয়ে দিদি, দশে বাবা, সতের’তে গেলেন মা!
আর বাইশ বছর ফাগুন মাস, যেদিন গেলো অপর্ণা!
আর শুধু ওরাই নাকি? কয়লার ট্রেন, দুঃখ পুকুর,
গরুর গাড়িটাও ছেড়ে দিয়েছে কাঁশফুলে ঢাকা নিশ্চিন্দিপুর!
বাবার উপর টান বলতে, খুব রোগা আর পলকা দড়ি।
রোগা দড়ি হেটে নামতো কাঁশিঘাটের চৌষট্টি সিঁড়ি।
বাবার আর লেখা হলনা গ্রাম জাগানো মহৎ পালা!
দীর্ঘশ্বাসে চাপা সংলাপ, শুধু শুনতে পেল গণেশ মহলা।
এখন মাঝেমাঝে স্বপ্নে আসেন,
হরিহর পালা গীতিকার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন,
“ঐ যায় শবযাত্রা আমার!
হরিধ্বনি দাও হে সবে, দুহাতে ওড়াও বিন্নি খৈ,
বাঁশের মাচায় শুয়ে চলেছেন, না লিখতে পারা আমার বই।”
ফিরে এলাম দেশের বাড়ি, ঘুরল আবার রেলের চাকা।
সম্বল বলতে গলার পৈতে, মা’র জমানো ছত্রিশ টাকা।
পল্লীবাড়ি একি আছে, ধোয়াটে মাঠ, কাঁশের বন।
নতুন একটা শব্দ শিখলাম, স্যারের কাছে, ‘এম্বিশন’
লিভিংস্টোন পড়ছি তখন কবে যাব আফ্রিকায়?
দেবতাকে অভুক্ত রেখে, এই পূরুতের ছেলে জলপানি পায়!
মাকে ছেড়ে, পল্লী ছেড়ে, পূরুতের ছেলে দূর পালালো,
দুর বলতে কলকাতা, তেতলা বাড়ি, ইলেক্ট্রিক আলো।
অখিল বাবুর রয়্যাল প্রেসে সারারাত জেগে কাজ করতাম।
নতুন বইয়ের মলাট দেখলেই ইচ্ছে হত, লিখি বাবার নাম।
একদিন একটা চিঠি এলো, মায়ের নাম লেখা তাতে,
মা লিখছেন ভাঙ্গা ছন্দে, মা লিখছেন কবিতাতে।
“অপু, আমার মাথার উপর উড়ছে জানিস, রাতের আকাশ।
কদিন পরেই গণেশ পূজো, তোরা কলেজে ছুটি কি পাস?
চারা গাছটা পুতে গেছিলি, কদিন হলো দেইনি জল,
গণেশ পূজোয় না এলেও তুই অঘ্রাণ মাসে আসবি বল?
কদিন ধরেই জ্বরটা আসছে, বলা হয়নি কথায় কথায়,
তোর তেতলা জানালা থেকে গ্রামের রাতটা দেখা যায়!
অপু, আমার মাথার উপর আকাশ ভাঙছে, উহ্! কি কালো!
পাঠাবি রে জোনাকি ঘুম, পাঠাবি-রে ইলেক্ট্রিক আলো?”
সেই থেকে তো শ্মশানের কাঠ, গারহস্তে আমার হলো অক্ষয়।
যারা চলে যায়, কে বলল শুধু তাদেরই শব দাহ হয়?
প্রথমে প্রথমে পুড়ে যেতাম, নতুন বিয়োগ চড়া আঁচে!
দেখ, সন্তাপ কথাটাতে তাপ কথাটা লুকিয়ে আছে!
একদিন তখন হবিষ্যি চলছে, এঁটো ছিটিয়ে ডাকছি কাক।
হঠাৎ মনে হলো, একি করছি, আমি-না হিমাদ্রী নন্দন মৈণাক!
সেই থেকে তো পালানো শুরু, থাকতে দেবে বৃক্ষবন?
তোমার সবুজ পাতার ভীড়ে রাখবে আমায়, রাখবে গোপন?
গাছ দেখলেই ভয় করে যে, চিতা কাঠ বড্ড ভয়!
শরীর জুড়ালো হঠাৎ করে, হঠাৎ শরীরে সূর্যোদয়!
মা, অপর্ণা মুছে গেল ওদের মুখের টুকিটাকি।
বলেই ফেলল অপর্ণার ছবি, হা করে দেখছো! আমি নতুন নাকি?
পুলু, একটা সত্যি কথা, এবার তবে বলি তোকে,
আমি মরে যাচ্ছি যন্ত্রণাতে, আমি মরে যাচ্ছি বিচ্ছেদ শোকে!
দিদি, বাবা, মা, অপর্ণা এরা না। কার কথা বলছি জানিস?
একটু ভালো করে মনে করে দেখ, তুইও ওদের খুব কাছ থেকে চিনিস।
মনে পরে সেই খুলনা যাওয়া পদ্মা নদী, ছবির সেট?
হঠাৎ তুই ডাকলি আমায়, হাতটা দে না ইডিয়েট।
হ্যা, ঐ গল্পের পাতা, আমার অপ্রকাশিত প্রথম বই।
গল্পের শুরুটা তুইও জানিস, গল্পের শেষটা গেলো কই?!
সেদিন গল্পে ঝিঁঝিঁ ডাকছিল, মাথার উপর বৃক্ষছাতা।
সূর্যোদয়কে সামনে পেয়ে, উড়িয়েছিলাম গল্পের পাতা।
ওরা কি সব ওখানেই আছে? চালে ডালে পাতা সংসার।
সংসার না বৈরাগ্য? কি জীবণ হয় ছেঁড়া পাতার?
এসব আমার জানা দরকার, এসব আমার জানা প্রয়োজন।
ব্যার্থ লেখক অপূর্ব রায়ের ওরাই হল আত্মা স্বজন।
ওরা আমার সাথে বাসে ওঠে, আমার সাথে অফিস করে।
শুধু পেছন ফিরে দেখতে গেলেই, ওরা বৃক্ষ বনে লুকিয়ে পড়ে
আর যখন ঘুমিয়ে পরি, ওরা স্বপ্নে আসে অহরহ
আসলে শুধু ছেড়ে এসেছি তো, কখনো ওদের করিনি দাহ
এখন আমার মায়ের বয়স, সন্ধে হলেই আসে জ্বর
বাবা বসে জল সেঁক দেয়, বলে অপু, লেখাটা শেষ কর।
পশ্চিমের টিকেট কেটেছি ভোর হলেই রওনা হব
খেলনা, মুখোশ, কলের গাড়ি; ওদের জন্য কি কি নেব?
গল্পটা যদি জিজ্ঞেস করে, এতদিন পর তুমি এদিকে?
আমি তাহলে সেদিনের সেই অবাক করা সূর্য ডেকে,
সব অধিকার ছেড়ে দেব।
লেখক, পিতা সব সব
লেখক শর্ত বিনিময়ে ফিরে পাবে ওরা শৈশব।
গোপন বলতে নিজের কাছে একটা নাম রাখবো শুধু, একটা নাম রাখবো শুধু,
পিতা নয় লেখক নয় স্বার্থ নয় শুধু বন্ধু।
চললাম পুলু, জানাব তোকে কি দেখলাম ছেঁড়া পাতায়।
ভালো থাকিস বইটা ছাপিস।
ইতি অপু… অপূর্ব রায়
 

খবরটি শেয়ার করুন...

Comments are closed.




© All rights reserved © 18-2023 boguratribune.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com